রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১১

গোয়াল বেচারা


গোয়ালা বেচারার ব্যবসামন্দা। আগের মত খদ্দের পায়না। দুধ বেচতে পারে না। তার খাঁটি গরুর দুধের আর চাহিদা নেই। খাঁটি গরুর দুধ বললে লোকজন নাক সিঁটকায়। বলে,গরুটা খাঁটি,দুধটা না। ঐ দুধে তো পানি মেশানো। ডিজিটাল বাংলাদেশের মানুষ ডিজিটাল দুধ খেয়ে অভ্যস্ত। মানুষ এখন পছন্দ করে আড়ং,মিল্কভিটা,প্রানের প্যাকেট করা পাস্তুরিত দুধ। তার প্রাকৃতিক দুধ আজকাল চলে না। গোয়ালা বেচারা তার দুধেল গাইগুলোকে দেখে,আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তাদের বাপ দাদাদের আমলে কি দিনই না ছিল। দুধ বেচে এক একজন গুলশান,বনানীতে ফ্ল্যাট কিনে ফেলত।গোয়ালা স্মৃতি রোমন্থন করে,এইতো সেদিনই,তার দুধের কি কাটতিটাই না ছিল।
এক লিটার দুধে দশ লিটার ওয়াসার পানি মিশিয়েও কুলোতে পারত না। মাসে মাসে মোবাইল সেট চেঞ্জ করত। আর এখন? সারা মাসে এক লিটার দুধ বেচতে পারলেও নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। আগে বেনসন টানত, এখন আকিজ বিড়ি পেলে অমৃত মনে হয়। পেটের তাগিদে গোয়ালাগিরি ছেড়ে এখন তাকে কুলিগিরি, মালীগিরি, জিগোলোগিরি, দাদাগিরি, নীলগিরি, লালগিরি- আরো অনেক গিরিংগিবাজি করে বেড়াতে হয়। কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটে। মঞ্জু সাহেব এলাকায় নতুন। নতুন বিয়ে করে এলাকায় বাসা নিয়েছেন। তার স্ত্রী, মিসেস মঞ্জু, যেমন তার বুদ্ধিমত্তা, তেমন তার রূপ,যেমন তার বাগ্নিতা, তেমন তার ফিগার। মঞ্জু সাহেব নিজেও অলস্কোয়ার একজন মানুষ। সব মিলিয়ে যাকে বলে, সোনায় সোহাগা এক জুটি। মঞ্জু সাহেবের বাতিক আছে, তিনি খাঁটি জিনিস পছন্দ করেন। শহুরে প্যাকেটজাত জিনিসের প্রতি তার আগ্রহ নেই। তাই গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়মিত তাকে ঘরের ঢেঁকিতে ভানা ধান, তাজা শাকসব্জি,ঘরে তৈরি মশলা,ইত্যাদি পাঠানো হয়। এলাকায় এসে তিনি শুনলেন, এখানে এক গোয়ালা আছে। তিনি লোক দিয়ে গোয়ালাকে ডেকে পাঠালেন। -কি হে,তুমি নাকি গোয়ালা? তা তোমার গরু ক’টি? -জ্বে,দুইটা। তিনটা ছিল। একটা ট্রেনের তলে পড়ে সুইসাইড করছে। -বল কি?? কেন?? -আজ্ঞে, কে বা কারা তার পশ্চাদ্দেশে……… -ব্যস। থামো এবার। তা তুমি দুধ দিতে পারবে তো প্রতিদিন দু’লিটার? -জ্বে অবশ্যই। -ঠিক আছে।তাহলে কাল থেকেই তুমি দুধ দেয়া শুরু কর। গোয়ালার কষ্টের দিন যেন ঘুচল। মঞ্জু সাহেবের বদৌলতে তার এখন মাস শেষে একটা বান্ধা ইনকামের পথ হল। আর দুধ দিতে গিয়ে তার প্রতিদিন দেখা হত সুন্দরী মিসেস মঞ্জুর সাথে। প্রথম দেখাতেই মিসেস মঞ্জুর প্রেমে পড়ে গেল গোয়ালা। তার বাঁকা চোখের চাহনি,তার গোলাপী ঠোঁটের রমনীয় হাসি, তার রেশমকালো চুলের দোলা-সব গোয়ালাকে নাড়া দিয়ে গেল। গোয়ালার দূরবস্থা দেখে তার প্রতি মঞ্জু সাহেবেরও কেমন মায়া বসে গেল। লোকটা খুব পরিশ্রমী। জানপ্রাণ দিয়ে খাটে। সব আদেশ বাধ্য ছেলের মত পালন করে। তিনি তাকে তাই তার বাসার আরো অনেক কাজে নিয়োজিত করলেন। তাকে বাজার করতে পাঠাতেন। তাকে দিয়ে ছোটখাট ফাইফরমাশও খাটাতে লাগলেন। গোয়ালাও সততার সাথে সব কাজ পালন করতে লাগল। মঞ্জু সাহেব ব্যবসার কাজে বাইরে যাবেন। তিনি তার স্ত্রীকে ডেকে বললেন, -আমি কয়দিনের জন্য ইউএসএ যাচ্ছি। তুমি সাবধানে থেক। -আমার জন্য চিন্তা কর না। তুমি সাবধানে ফিরে আস। -বাসায় তো বড় কেউ নেই। তুমি বরং পাশের বাড়ির ভাবীকে ডেকে কয়েকদিনের জন্য থাকতে বল। মঞ্জু সাহেব গোয়ালাকে ডেকে বল্লেন,তোর ভাবী একা থাকছে। দেখিস।সমস্যা হলে সাহায্য করিস। গোয়ালা বাধ্য ছেলের মত মাথা নাড়ে। জেএফকে এয়ারপোর্টে নেমে মঞ্জু সাহেব স্ত্রীকে ফোন দিলেন, -হ্যালো -জ্বে। -কে?? -জ্বি আমি গোয়ালা। -তুমি আমার বৌএর মোবাইল নিয়ে কি করছ? ও কই? -জ্বে ভাবী তো আমার বাড়ি। -সে কি করে তোমার বাড়ি? আর তুমিই বা কি কর? -জ্বে আমি দুধ দোয়াই। -মানে??!!? -আমি তো আমার কালা গরুর দুধ দোয়াই। ভাবী আইসা কইল যে কি নাকি নতুন বাগান করব, আমারে যাইতে কয়। -ওহ।আমি ভাবলাম কি না কি। ঠিক আছে। তোমার ভাবীকে সাহায্য কর। -(মিসেস মঞ্জু ফোন ধরে) হানি তুমি কেমন আস? ঠিকমত পৌছাইস? খাওয়াদাওয়া করস? কোন সমস্যা হয় নি তো? -না কোন সমস্যা হয় নি……………… বৌ এর সাথে কথা সেরে মঞ্জু সাহেব হোটেলে ফিরলেন। পরেরদিন সারাদিন ব্যবসার কাজ করে রাতে হোটেলে ফিরে বৌকে ফোন দিতে চাইলেন। কি ভেবে ফোন দিলেন গোয়ালাকে। -কি কেমন আছ? -জ্বে ভাল। -কি কর? -জ্বে ভাবীর আগাছা,ঝোপঝাড় পরিষ্কার করি। -মানে??!! -আপনাদের বাগানের বহুত আগাছা,পরিষ্কার না করলে বাগান করমু কেমনে? মঞ্জু সাহেব কিছু বলেন না। ফোন রেখে দেন। পরের রাতে তিনি আবার গোয়ালাকে ফোন দেন -কি কর? -জ্বে ভাবীর ক্ষেতে মই দি। -হম। মঞ্জু সাহেবকে চিন্তিত দেখায়। তার পরের রাত- -কি মই দেয়া শেষ? -জ্বে।এখন ভাবীর ক্ষেতে লাঠি দিয়ে গর্ত করি। মঞ্জু সাহেবের আর সহ্য হয় না। তিনি স্ত্রীকে ফোন দেন -গোয়ালা ডিস্টার্ব দিচ্ছে না তো? -কি যে বল,ও তো খুবই কাজের ছেলে। লাঠি দিয়ে যা সুন্দর গর্ত করে। তুমিও এত সুন্দর গর্ত করতে পার না। আর ওতো পাশের বাড়ির ভাবীর ক্ষেতেও গর্ত করে দিয়ে আসছে। খুবই কাজের ছেলে। মঞ্জু সাহেব বিভ্রান্ত হয়ে যান। হচ্ছেটা কি?? পরের রাত- -গোয়ালা,কি কর? -জ্বে,আজ ভাবীর ক্ষেতে লাঠি দিয়া বীজ পুঁতলাম। ইনশাল্লা টাইমমত ফল পাইবেন। মঞ্জু সাহেবের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়।তিনি ওয়ারেন বাফেটের সাথে জরুরী মিটিংটা ক্যানসেল করে ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে ফিরে আসেন দেশে। দেশে ফিরে মঞ্জু সাহেব নিজের বাসায় না গিয়ে সোজা গোয়ালার বাড়ি যান। গিয়ে দেখেন,গোয়ালা গুনগুন করে গাইছে,হাওয়া মে উড়তা যায়ে,তেরা লাল দুপাট্টা মলমল কা, আর তার হাতে তার বৌ এর ওড়না পেঁচানো। মঞ্জু সাহেব আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেন না। তিনি ঘরে রাখা একটা চেলা কাঠ তুলে কোন কথা না বলে পিটাতে শুরু করেন গোয়ালাকে। গোয়ালা,আরে সার করেন কি করেন কি বলে বাধা দিতে আসে। কিন্তু মঞ্জু সাহেবের উপর তখন অসুর ভর করে। তিনি প্রচন্ড মার মেরে গোয়ালাকে আধ্মরা করে ফেলেন। তারপর ফিরে আসেন নিজের বাড়ি। ঘরে ফিরে তিনি তার স্ত্রীকে ডাকেন। -আমি চলে গেছি মাত্র এক সপ্তা হল আর তুমি কি শুরু করলে?? ছি ছি। -কি বলছ তুমি? কি করেছি আমি? -তুমি আর গোয়ালা…. -কি বল তুমি? গোয়ালা তো আমাকে সাহায্য করছিল। এই যে দেখে যাও সে বাগানের কাজ প্রায় শেষ করে ফেলছে। মঞ্জু সাহেব গিয়ে দেখেন সত্যি বাগানের কাজ শেষ। তবে কি গোয়ালাকে তিনি ভুল বুঝলেন? -কিন্তু, তোমার ওড়না ওর কাছে কেন? -আরে, ওর একটা বান্ধবী আছে। তুমি জান না? ওই মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। আমি ওকে ওড়নাটা দিয়ে দিয়েছি। এমন সময় পাশের বাড়ির ভাবী চলে আসেন। তিনি বলেন, -মঞ্জু সাহেব,আপনি ভুল বুঝছেন। আমি আপনার বাসায় ছিলাম। গোয়ালা খুবই ভালো ছেলে। আপনি শুধু শুধু তার ওপর আর ভাবীর ওপর সন্দেহ করছেন। -(মিসেস মঞ্জু ) ছি মঞ্জু, তুমি আমাকে অবিশ্বাস করতে পারলে?? আর তাও এক বস্তির লোকের জন্য? -(মঞ্জু সাহেব বিভ্রান্ত) দেখ,আমার মনে হয় ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও। আমি অযথা তোমাকে আর গোয়ালাকে সন্দেহ করেছি। মঞ্জু সাহেব গোয়ালার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সে সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে নিজের টাকায় একটা দোকান করে দেন। গোয়ালার অবস্থা সচ্ছল হয়ে ওঠে। এক বছর পর, মঞ্জু সাহেবের একটা ছেলে হয়। ছেলের পায়ে একটা জন্মদাগ দেখা যায় যেটা দেখতে অনেকটা ৭”(সাত ইঞ্চি)র মত। মঞ্জু সাহেব ভেবে পান না, এইরকম অদ্ভুত একটা দাগ কেমন করে তৈরি হল। -এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন