শুক্রবার, ৩ আগস্ট, ২০১২

চাওয়া পাওয়া মানেই জীবন !


আরও জোরে ঝুম্পা ! আরও জোরে ! তোকে জিততেই হবে !! আরও জোরে ছোট ! কাম অন ঝুম্পা ! কাম অন !!
স্টেডিয়ামের সাইডে দাঁড়িয়ে তন্ময় সমানে চিল্লিয়ে যাচ্ছে ! আর স্টেডিয়ামের মধ্যে অনেক মেয়ের সাথে দৌড়ে যাচ্ছে ঝুম্পা ! বয়স পনের ! পুরো শরীর ছিপছিপে চাবুকের মতো ! দেখলে মনেই হয় যে একটা আগুন ছুটছে ! তাকে ধরার সাধ্য কারুর নয় !.
ঝুম্পা খুবই গরিব ঘরের মেয়ে মা বাবা দুজনেই লোকেদের মাঠে ঘটে কাজ করে যা পায় তাই দিয়ে কোনরকমে সংসারটাকে টিকিয়ে রেখে দিয়েছে ! বাবা সনাতন হালদার আগে একসময় জুটমিলে কাজ করত তখন তাদের খুবই সু সময় ! তখন সনাতন হালদারের বয়স মাত্র ২৪ বছর ! বুড়ি মা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সনাতন হালদারের বিয়ে দিলেন বীরভূমের কোনো এক গরিব আত্মিয়ের মেয়ে সুকন্যার সাথে ! সুকন্যা বউ হিসাবে খুবই ভালো ছিল ! সনাতনের সংসারের হাল হাসিমুখে ধরে বৃদ্ধা শাসুরির সেবা যত্ন সব খুব ভালো ভাবেই সামলে নিয়েছিল ! বিয়ের দেড় বছরের মাথায় ঝুম্পার জন্ম ! বাড়ির প্রথম মেয়ে বলে আদরের কোনো কম ছিলনা ! ঠাকুমা নাতনি বলতে অজ্ঞান ! তিনিই নাতনিকে নিয়ে শুতেন ! তাকে খাওয়ানো পরানো সব তিনিই করতেন ! এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দিতেন না ! দেখতে দেখতে প্রায় ৫ বছর কেটে গেল ! ঝুম্পার বাবা সনাতন হালদার মেয়েকে নিয়ে এলে গ্রামের প্রভাবতী বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করবেন বলে ! স্কুলের হেড মাস্টার মসি প্রথম দেখাতেই সনাতনকে বললেন তোমার এই মেয়ে একদিন তোমাদের নাম উজ্জল করবে ! খুবই বুদ্ধিমতি !
সময়ও খুব মসৃন ভাবে গড়িয়ে যাচ্ছিল ! এইরকমই ভাবেই ঝুম্পা ক্লাস ফাইভে উঠলো ! পড়াশোনাতে ঝুম্পার যেমন মাথা তেমনি বুদ্ধি ! প্রতিটি ক্লাসে ঝুম্পা প্রথম হয় !
প্রতিদিনের মতই ঝুম্পা ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিল সেদিনও! ভোর বেলায় যখন ঝুম্পার খুব জোরে প্রকৃতির ডাক পেয়েছে তখন ঝুম ঠাকুমাকে ঠেলা দিয়ে বলল " ঠাকুমা ওঠো আমার খুব জোরে হিসি পেয়েছে ! আমার ভয় করছে ! আমাকে দাঁড়াবে চল ! কিন্তু ঠাকুমার কোনো সারা শব্দ নেই !
অনেক ডাকাডাকির পরেও যখন ঠাকুমার কোনো সারা পাওয়া গেলনা তখন ঝুম্পা অর মা বাবার দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো ! এত ভোরে দরজায় ধাক্কার শব্দে সনাতন হালদারের ঘুম ভেঙ্গে গেল ! দরজা খুলে দেখলেন ঝুম্পা অঝোরে কাঁদছে আর বলছে ঠাকমা কথা বলছে না !
সনাতন হালদার তার মাকে দেখেই বুঝে গেলেন যে তিনি আর নেই ! তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন !!সাথে সাথে গত বাড়িতে কান্নার রোল উঠলো !! অত ভোরে সনাতনের বাড়ি থেকে কান্নার শব্দে গ্রামের অনেকে ছুঁটে এলেন ! কিন্তু তখন আর কিছুই করার নেই ! সনাতন হালদারের মা নীলিমা দেবী ইহজগতের মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন ! হালদার বাড়িতে শোকের ছায়া ! ঝুম্পাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছেনা যে তার ঠাকুমা আর নেই !
সময় কোনদিন থেমে থাকে না ! সময় সময়ের নিয়মেই চলতে থাকে ! এগিয়ে যায় ! শুধু তারাই পিছনে পরে থাকে যারা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না ! ঝুম্পা এখন ক্লাস সিক্সে পরছে ! ঝুম্পার একটা চত ভাইও হয়েছে ! ঝুম্পার যেমন বাড়িতে ডাক নাম ঝুম সেই নামের সাথে নাম মিলিয়ে তার নামও রাখা হয়েছে বুম ! সময় শুধুই এগিয়ে চলেছে !
একদিন স্কুল যাবার পথে ঝুম্পার পিছনে একটা খেপা ষাঁড় তারা করে ঝুম্পা প্রাণপনে দৌড়ে চলেছে স্কুলের দিকে ! ঠিক সেই সময়েই রাস্তার ধারে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বয়েজ স্কুলের গেম টিচার তন্ময় ঘোষ ! শান্রের দিকে তার নজর ছিল না ! নজর ছিল ঝুম্পার পায়ের দিকে ! কি বিভত্স গতিতে মেয়েটার পা কাজ করে চলেছে ! অনেক পরে তন্ময় ঘোষের চমক কাটল ! উর্ধশাসে সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন ঝুম্পাকে ষাঁড় এর হাথ থেকে ঝুম্পাকে বাঁচানোর জন্য ! ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে ! ঝুম্পা স্কুলের গন্ডির ভিতর ঢুকে গাছে আর আসে পাশের লোকেরা ষাঁড় তাকে তারা করেছে !
ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে ! ঝুম্পা স্কুলের গন্ডির ভিতর ঢুকে গাছে আর আসে পাশের লোকেরা ষাঁড় টাকে তারা করেছে ! সাইকেল থেকে নেমে তন্ময় আশেপাশের লোকেদের জিগাস্সা করলেন যে মেয়েটার কোনো ক্ষতি হয়নি তো?? সবাই এক বাক্যে জবাব দিল না মেয়েটা খুব জোর বেঁচে গেছে ! যদি অত জোরে না দৌরাত তাহলে হয়ত আজ কিছু একটা অঘটন হয়ে যেত !
তন্ময় বাবু নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না ! সাইকেল টাকে গেটের বাইরে রেখে তিনি গার্লস স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকে পড়লেন ! দেখলেন সেখানে একটা জটলা ! ঝুম্পা মাটিতে বসে হাঁপাচ্ছে আর অনেক গুলো মেয়ে আর দিদিমনিরা ঝুম্পাকে ঘিরে রয়েছে !!
তন্ময়্বাবু ওদেরকে বললেন দয়া করে সবাই ওকে ছেড়ে দিন ওকে একটু হাওয়া নিতে দিন ! আপনারা ঘিরে ধরলে ও হাওয়া পাবে না ! তাতে অর স্বাস কষ্ট শুরু হবে ! ওকে একটু খোলা হাওয়ায় থাকতে দিন ! এখন যেন কেউ ওকে জল দেবেন না ! একটু ধাতস্থ হয়ে নিক আগে ! তারপরে ওকে জল দেবেন ! সবাই তন্ময় বাবুকে অবাক দৃষ্টি তে দেখতে লাগলেন ! গার্লস স্কুলে একজন পুরুষ মানুষ ঢুকে পরেছে ! তন্ময় বাবু কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই ঝুম্পার দিকে এগিয়ে গেলেন ! ঝুম্পার পিঠে হাথ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দলে দিলেন ! ঝুম্পা একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল " একটু জল খাব !" সাথে সাথেই ওর মুখের সামনে জলের গ্লাস ধরলেন স্কুলের এক দিদিমনি !! তন্ময় বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন " আমি যদি ভুল না করি আপনি তন্ময় ঘোষ ! বয়েজ স্কুলের নতুন গেম টিচার ! তাইত??"
- একদম ঠিক বলেছেন ! আমি নতুন জয়েন করেছি বয়েজ স্কুলে ! স্কুল যাওয়ার পথে দেখলাম এই মেয়েটাকে ষাঁড়ে তারা করেছে ! আমিও পিছনে পিছনে দৌড়ে এখানে চলে এসেছি ! যাক বাবা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল ! কিন্তু এই মেয়েটি কে? কি নাম এর ??
- ও ঝুম্পা হালদার ! ক্লাস সিক্সে পরে ! স্কুলের সবথেকে ভালো ছাত্রী !
- ভালো ছাত্রী কিনা জানিনা তবে ও একজন ভবিস্যতের স্পোর্টস স্টার ! ওকে যদি ঠিক মত ট্রেনিং দেওয়া যায় তো একদিন আমাদের দেশের নাম উজ্জল করবে এটা আমি হলফ করে বলতে পারি !!
কথা বার্তার মাঝেই স্কুল বসার ঘন্টা পরে গেল ! তন্ময় বাবু গার্লস স্কুল থেকে বেরিয়ে বয়েজ স্কুলের দিকে হাঁটা দিলেন !

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে কিন্তু তন্ময় বাবুর মন থেকে দুটো দুরন্ত পা কিছুতেই হারাচ্ছে না ! রোজ ওই দুটো দুরন্ত পা তন্ময় বাবুকে টানে ! একটা ভবিসত্তের স্পোর্টস স্টার কে দেখতে পান তিনি ! কিন্তু কি করবেন? তিনি বয়েজ স্কুলের টিচার আর মেয়েটি গার্লস স্কুলে !! অনেক ভেবে কিছু ঠিক করতে না পেরে তিনি সরনাপন্ন হন বয়েজ স্কুলের হেডস্যারের কাছে ! তিনি শুরু থেকে সমস্ত কথা খুলে বলেন ! হেডস্যার বিনয় কৃষ্ণ ঘোষ এই এলাকার একজন নামী লোক ! লোকে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে! এই স্কুল দুটি ওনার বাবা গৌতম চন্দ্র ঘোষ করে গেছিলেন ! গার্লস স্কুলের নাম দিয়েছিলেন তার মায়ের নামে প্রভাবতী বালিকা বিদ্যালয় আর বয়েজ স্কুলের নাম দিয়েছিলেন তার বাবার নামে উত্তম চন্দ্র বিদ্যালয় ! উত্তম বাবু ছিলেন সাধীনতা সংগ্রামী ! তার স্ত্রীও তার সাথে সেই সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন ! তারা এই এলাকার নমস্সো লোক ! সেই পরিবারের ছেলে বিনয়কৃষ্ণ বাবু লন্ডন থেকে পড়াশোনা করেও অন্য কথাও চাকরি করেননি ! সোজা চলে এসেছিলেন গ্রামে ! নিজের বাবা মায়ের সপ্ন সফল করতে ! সমাজ কে শিক্ষা দেবেন বলে নিজেদের স্কুলের সঞ্চালন নিজের কাঁধেই নিয়ে নেন ! যতদিন না সরকারী অনুদান পেয়েছে ততদিন নিজের পকেট থেকে সমস্ত শিক্ষকদের মাইনে দিয়েছেন! সমস্ত স্কুলের খরচা বহন করেছেন ! পরে প্রফুল্ল বাবু যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য মন্ত্রী হয়েছিলেন সেই সময় সে দুটি স্কুল কে সরকারী সীকৃতি দেওয়া হয় ! সর্ত বিনয় বাবু এবং তা স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে দুটো স্কুলের ভারই নিতে হবে !! সেই থেকেই বিনয় বাবু বয়েজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর বাসন্তী দেবী গার্লস স্কুলের !!
সমস্ত শুনে বিনয় বাবু বললেন " আচ্ছা আপনি বলছেন যে মেয়েটা আমাদের দেশের নাম উজ্জল করবে??"
হ্যা স্যার ! আমি নিজে একজন স্পোর্টস ম্যান ছিলাম স্টেটের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতেও খেলেছি ! আবার স্টেটের হয়ে দৌরেছিও !চুনি গোস্বামী আর আমি একসাথে ক্রিকেট খেলেছি, ফুটবল খেলেছি ! কিন্তু স্পোর্টসে এত পলিটিক্স চলে এসেছে তাই সব ছেড়ে চুরে এই স্কুলে জয়েন করেছি ! আমার সপ্ন একটাই এই দেশ কে ভালো স্পোর্টস ম্যান দেওয়া !! যদি আপনি একটু সাহায্য করেন আমি হলপ করে বলতে পারি ওই মেয়েটি আমাদের গ্রামের গৌরব হবে !
বিনয় বাবু একটু ভেবে বললেন " চলুন তাহলে দেখা যাক মেয়েটি কে?
- কিন্তু স্কুলের হেডমিস্ট্রেস কি আমাদের এলাও করবেন??
- সেটা আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন ! ওই স্কুল্টাও আমার বাবার তৈরী করা আর ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা আমার স্ত্রী !! চলুন দেখা যাক !!
বিনয় বাবুর কথা মতো তন্ময় বাবু বিনয় বাবুর সাথে গার্লস স্কুলের দিকে রওয়ানা দিলেন ! রিকশাতে যেতে যেতে বিনয় বাবু জিগ্গাস্সা করলেন " আচ্ছা তন্ময় তুমি তো এখানে চাকরি নিয়ে চলে এসেছ? তোমার বাবা মা বা স্ত্রী এরা সবাই কোথায়??
তন্ময় মুখ নিচু করে বলল ! কেউ নেই স্যার আমি এই পৃথিবীতে একা !
-মানে?? না স্যার আমি একজন অনাথ ! ছোট থেকে যাদের বাবা মা বলে জেনেছি তারা আমাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়ে মানুষ করেছেন ! তারা একবার বৈষ্ণদেবী ঘুরতে গেছিলেন আজ থেকে ৩০ বছর আগে ! যাওয়ার পথে আমাকে ট্রেনের কামরায় কুড়িয়ে পান ! তারা অনেক খোজাখুজি করেও আমার মা বাবার খবর যোগার করতে পারেননি ! যখন আমার বয়স পাঁচ ! তখন শুধু আমার নাম টা আমার মনে ছিল ! সেটা বলেছিলাম ! তারা অনেক খুজেও যখন কাউকে পেলেন না তখন তারা জম্মু পুলিশের কাছে রিপোর্ট করলেন ! কিন্তু কোনো কাজ হলো না মাঝ খান থেকে ওনাদের পুলিশ কোর্ট কাছারির জন্য হেনস্থা হতে হয়েছিল ! আমি তখন কিছুই বুঝতাম না কারণ আমার মাতৃ ভাষা বাংলা ছিল না ! ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম ! কারণ ওনারা বাংলায় কথা বলতেন আমি কিছুই বুঝতাম না ! আর ওনারা হিন্দী বলতে পারতেন না ! আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম ! আমার তাকানো দেখে ওনারা আমার নাম রাখেন তন্ময় ! আমার মা বাবার আমার উপর মায়া পরে গেছিল ! আমাকে ওনারা কোর্টে হলফনামা দায়ের করে নিজেদের করে নেন ! ওনাদের কোনো ছেলেপুলে ছিল না ! তাই আমি বড় আদরে ওনাদের সাথে মানুষ হচ্ছিলাম ! হটাত একদিন আমার বাবা সুজিত ঘোষ যিনি একজন মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টিভ ছিলেন একটা রোড এক্সিডেন্ট পঙ্গু হয়ে পড়লেন ! তখন আমার বয়স পনের ! নিজেদের যা জমানো পুঁজি ছিল তা দিয়ে তার চিকিত্সা করানো হলো ! কিন্তু কোনো লাভ হলো না ! দীর্ঘ দুই বছর তিনি কষ্ট পেয়ে পেয়ে মরে গেলেন ! আমি তখনও জানিনা আমার আসল বাবা মা কে !! তার মৃত্যুর পর মা আমাকে তার ডায়রি এনে দিলেন ! সেখান থেকেই আমি জানতে পারলাম যে আমি তাদের সন্তান নই ! কিন্তু তারা আমাকে কোনদিন সেটা বুঝতে দেননি ! বরঞ্চ আমার বাবার বিশ্বাস ছিল আমি তাদের নাম উজ্জল করব !! ছোট থেকেই আমি খুবই ডানপিটে ছিলাম !খেলাধুলায় এক নম্বরের ! আমার শক্তির সাথে আমার সমবয়সী বা আমার থেকে বড় কোনো ছেলে পেরে উঠত না !!
কিন্তু যেদিন আমি মায়ের দেওয়া বাবার ডায়রি পরলাম আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল !! আমি কে? কি আমার পরিচয় ?? তার থেকেও বড় কথা আমার পালিত বাবার কোনো সঞ্চিত অর্থ ছিল না ! থাকার মধ্যে তার বাড়িটা যেটা তিনি উইল করে আমার নামে লিখে রেখে গেছিলেন ! আমার মা আমাকে বললেন "দ্যাখ তনু ! আমি তোকে কিছুই জানাতে চাইনি ! আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি তুইই আমাদের ছেলে আমাদের শেষ সম্বল ! কিন্তু তোর বাবা মৃত্যুসজ্জায় আমার কাছে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিল যে আমি যেন তোকে সত্যি কথা জানাই ! তাই আমি তোর বাবার লেখা ডায়রিটা তোকে দিয়েছিলাম পরার জন্য ! তোর কাছে আমাদের কিছুই চাওয়ার নেই ! কিন্তু তোকে আমাদের যা বা যতটুকু দেবার আমরা সব দিয়েছি ! এবার তুই ঠিক করে নে তোর বা আমার ভবিস্যত কি ?? সেদিন আমি মায়ের পায়ের উপর পরে খুব কেঁদেছিলাম !! মাগো আমি জানিনা আমি কে আর জানতেও চাইনা ! তোমার থেকে আমাকে দূর করো না ! মা আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিল !! আমি আজ মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আমার বাবার নাম সুজিত ঘোষ আর মায়ের নাম মমতা ঘোষ ! আজ তারা দুজনেই এই পৃথিবীতে নেই ! আমি তাদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একটা সভ্য সমাজ আর সুস্থ ভবিস্যত গড়ার ! তাই আজ আমি বিয়ে করিনি ! আমার জীবনের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ আমি আমার মা বাবার নামে ট্রাস্ট করে রেখেছি সেই দিনের জন্য যেদিন দেখব কোনো গরিবের ছেলে পয়সার অভাবে পড়তে পারছেনা বা কেন অনাথ তার পরিচয় খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না সেদিন আমার ওই অর্থ আমার বাবা মায়ের সপ্ন পূরণ করবে !!"
"সুজিত মমতার সপ্নাবলোম্বন " আমার ট্রাস্টের নাম ! চেষ্টা করে চলেছি আমার যা রোজগার তাই দিয়ে তাকে বাঁচানোর !
- বা খুব সুন্দর ! তোমার সম্বন্ধ্যে আমার ধারণা আরও উঁচু হলো তন্ময় ! তুমি সত্যিই একটা মহৎ কাজ করতে চলেছ ! কিন্তু এটা বুঝতে পারছিনা এটার সাথে তোমার বিয়ে না করার সম্পর্ক তা কোথায়?
- না স্যার ! আমি কোনো পারিবারিক বন্ধনে নিজেকে বাঁধতে চাইনা ! পরিবার হলেই একটা বন্ধন আর বন্ধন মানেই আমার বাবা মায়ের সপ্নো অসুম্পূর্ণ থেকে যাবে ! তারা গরিব হয়েও যদি আমার মত অনাথকে মানুষ করতে পারেন আমি তো আর গরিব নই ! আমি কেন পারব না তাদের সেই ইচ্ছা টাকে পূরণ করতে ? !!
- তন্ময় তোমার আদর্শ কে আমি শ্রদ্ধা করি ! আমার কাছ থেকে তুমি যদি কোনো সাহায্য চাও তাহলে জানব অন্তত কিছুটা হলেও সমাজের কাজে আসতে পেরেছি !
- কি যে বলেন স্যার ! আপনার মতো মহৎ ব্যক্তি যিনি নিজের ভবিস্যত ছেড়ে একটা সুস্থ সমাজ গড়ার কাজে নিজেদের জীবন টাকে বিলিয়ে দিলেন তার কাছে আমার এই স্বার্থ ত্যাগ তো তুচ্ছ ! চাকরি আমি অনেক পেয়েছিলাম ! কিন্তু যখন এই স্কুলের জন্য আমার কাছে অফার এলো আমি সম্পূর্ণ খোঁজ করে জানতে পারলাম যে আপনি বা আপনার পরিবারের কত বড় দান এই স্কুলের প্রতি এই সমাজের প্রতি আমাদের শিক্ষার প্রতি ! আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেছিলাম ! আমার বন্ধুরা আমায় জিগ্গাস্সা করেছিল যেখানে আমার হাতে অনেক বেশি মাইনের চাকরি আছে সেখানে আমি কেন এত কম মাইনের চাকরি নিয়ে আমার ভবিস্যত পায়ে কুড়ুল মারছি !! আমি শুধু তাদের বলে ছিলাম একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষা নিতে যাচ্ছি একটা সুস্থ সমাজ গড়ার ! আপনি আমার আদর্শ স্যার ! আমার বাবা মায়ের পরে আমি যদি কাউকে ভগবান বলে মানি সেটা আপনি !
- শুনে খুব আনন্দ পেলাম তন্ময় ! একজন প্রকৃত শিক্ষক কে পেয়েছি আমার স্কুলে ! যদি আর সব শিক্ষক তোমার মতো হত তাহলে আজ আমাদের দেশ অনেক এগিয়ে যেত !!
কথা বলতে বলতে কখন যে রিক্সাটা গার্লস স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে পরেছে কেউই খেয়াল করেন নি !! চমক ভাঙ্গলো রিকশাঅলার গলার শব্দে ! " আসুন স্যার আমরা এসে গেছি !!
- যদু তুই কিন্তু এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবি! আমাদের একটু দেরী হবে আসতে ! কোনো অসুবিধা নেই তো !!
- কি যে বলেন স্যার ! আপনি যদি বলেন আমি সারাজীবন রিক্সা নিয়ে আপনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকব ! আপনি ঘুরে আসুন স্যার !
তন্ময় অভিভূত হলো একটা সামান্য রিক্সাওয়ালার শ্রদ্ধা দেখে !!
দুজনে যখন স্কুলের গেটের মধ্যে ঢুকলেন গেটের দারওয়ান স সম্ভ্রমে মাথা নিচু করে স্যার কে সম্বর্থনা জানালেন ! আসুন স্যার !!
- ম্যাডাম কোথায়??
- উনি ওনার অফিসেই আছেন স্যার ! আমি কি খবর দেব??
- না না আমিই যাচ্ছি !! চলো !
দারওয়ান আমাদের আগে আগে হেড মিস্ট্রেসের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে ম্যাডাম কে বললেন " ম্যাডাম স্যার এসেছেন আনবো ওনাকে ?
চোখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে যেই দরজার দিকে তাকিয়েছেন দেখতে পেনেন বিনয় বাবু দাঁড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাষা বদলে গেল ! আরে এসো এসো ! আজ হটাত আমার স্কুলে কি ব্যাপার ? এতদিন স্কুল কমিটি থেকে ডেকে ডেকেও তোমাকে এখানে আনা যায়নি ! আর আজ মেঘ না চাইতেই জল !
তন্ময় বেশ ভালই বুঝতে পারল পারিবারিক জীবনে এনারা দুজন স্বামী স্ত্রী হলেও কর্মক্ষেত্রে দুজনের আলাদা অস্তিত্ব এবং স্বকীয়তা আছে ! কেউ কারুর কাজে হস্তক্ষেপ করেন না !
- এসো তন্ময় ! আলাপ করিয়ে দিই ! ইনি আমার স্ত্রী বাসন্তি দেবী যেটা আমাদের ঘরের মধ্যের সম্পর্ক ! আর বাইরের সম্পর্ক হলো ইনি এই প্রভাবতী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা !
তন্ময় হাত জোর করে নমস্কার করলেন !
বিনয় বাবুই বলে উঠলেন " এ হচ্ছে তন্ময় ঘোষ আমাদের স্কুলের নতুন গেম টিচার ! ওর এখানে কিছু সমস্যা হচ্ছে আর সেই সমস্যার সমাধান একমাত্র তুমিই করতে পার ! তাই আমি ওকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি !" সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে তিনি বাসন্তি দেবী কে বললেন !!
-- কিন্তু কোন মেয়েটির কথা বলছেন বলুনতো? আমাদের স্কুলে প্রায় ১৮০০ মেয়ে পরে ! এবার তাদের মধ্যে কার কথা আপনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না ! বাসন্তি দেবী বললেন তন্ময় কে !
- চার পাঁচদিন আগে একটা বছর দশেকের মেয়েকে ষাঁড়ে তারা করেছিল ! আমি সেই মেয়েটার কথা বলছি !
- দাঁড়ান দাঁড়ান ! বলেই তিনি টেবিলের উপরে রাখা বেলটিতে আঙ্গুল রাখলেন ! বাইরে টিং টং করে আওয়াজ হলো আর সাথে সাথেই পিওন জাতীয় মহিলা এসে বললেন " ইয়েস ম্যাম ?"
- একবার অনামিকা দিদিমনিকে ডেকে আনুন তো !
- দিদিমনি এখন ক্লাসে আছেন ! সেখান থেকে ডেকে আনব ম্যাডাম??
-হ্যা ! যাও বলবে একটু তারাতারি আসতে আর মলিনা ম্যাডামের এখন ক্লাস নেই ওকে বল অনামিকা ম্যাডামের ক্লাসে যেতে !
- ঠিক আছে ম্যাডাম ! বলেই ভদ্রমহিলা চলে গেলেন ! অনার যাওয়ার প্রায় সাথে সাথেই একজন বছর চলিস্সের মহিলা দরজার বাইরে থেকে বললেন আমি আসব ম্যাডাম?
- আরে হ্যা মলিনা আপনি একবার অনামিকার ক্লাস এটেনড করুন আর ওকে বলুন এখুনি যেন আমার সাথে দেখা করে !
- ঠিক আছে ম্যাডাম !
- দেখুন তন্ময় বাবু যতটুকু আপনার কথা শুনলাম তাতে মোনে হচ্ছে ! আপনি বোধ হয় ক্লাস সিক্সের ঝুম্পা হালদারের কথা বলছেন ! মেয়েটা লেখাপড়ায় খুব ভালো কিন্তু খেলাধুলায় মেয়েটার ন্যাক আছে সেটাতো জানিনা ! তবে অবস্সো আমাদের স্কুলে খেলাধুলার সে রকম কোনো ব্যবস্থাও নেই ! তাই হয়ত আমরা জানতে পারিনি ! তবে এবার আমরা চেষ্টা করছি যাতে আমাদের স্কুলে স্পোর্টস সেকসন খোলা যায় ! আমাদের স্কুলের পিছনের জমিটা বিনয় বাবুর ওনাকে অনুরোধ করব ভাবছি যাতে উনি জমি টা দিয়ে দেন! বলেই উনি হো হো করে হেঁসে উঠলেন ! আর তার হাঁসির সাথে যোগ দিলেন বিনয় বাবু নিজে !
- ও পারোও বটে তুমি ! নিজের জমিকে আমার জমি বলে চালাচ্ছ ! মোনে নেই তোমাকে আমি ওই জমি টা দিয়ে দিয়েছিলাম !!
- হ্যা তা দিয়েছিলে বটে কিন্তু কাগজ কলমে তো দাও নি ! এবার না হয় কাগজ কলমে জমিটাকে আমাদের স্কুলের নামে করে দাও ! তাহলে আমার মেয়েরা একটা প্লেগ্রাউন্ড পাবে !!
তন্ময় খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছিল এনারা স্বামী স্ত্রী দুজনেই এই সমাজ কে কত টা ভালবাসেন আর তাদের যা কিছু আশা প্রত্যাশা সব এই দুই স্কুল কে ঘিরে ! এনাদের দুজনের সপ্নই একটা শিক্ষিত সমাজের সৃষ্টি করা ! মোনে মোনে তন্ময় দুজনকেই প্রনাম করলেন !!
- আমাকে ডেকেছ কাকিমা??
- তোকে কতবার না বলেছি স্কুলে আমাকে কাকিমা বলবি না ! ম্যাডাম বলবি? একটা স্নেহের ধমক দিলেন অনামিকা বলে মেয়েটাকে !
- সরি ম্যাডাম কাকিমা ! কাকু স্যার ভালো আছ ! মেয়েটার ব্যবহারে একটা চুটল চাতুর্য আছে !
- এই হলো অনামিকা আমাদের স্কুলের সেকেন্ড ইন কমান্ড ! আমার ভাইজি কাম মেয়ে কম সব কিছু !! বলেই বিনয় বাবু সস্নেহে অনামিকার মাথায় হাত বুলোলেন !!
- আরে তন্ময় বাবু যে ! আজ হটাত আমাদের স্কুলে ! আমাদের স্কুল জয়েন করার কথা ভাবছেন নাকি?? তন্ময় কে উদ্দেস্সো করে অনামিকা একটা চুটল প্রশ্ন করলো !!
- আ তুই থামবি? এনাকে তুই চিনিস?
- কেন চিনব না ! ইনিই তো সেদিন ঝুম্পার পিছনে ষাঁড় টাকে তারা করেছিলেন !!
- না মোটেই আমি ষাঁড় টাকে তারা করিনি ! আমি ঝুম্পাকে বাঁচানোর জন্য ষাঁড় টার পিছনে ছুটছিলাম !!
- আরে বাবা তার মানে তাই হলো নাকি? আপনি কি ষাঁড় এর পিছনে দৌরচ্ছিলেন না??
এতো মহা ফাজিল মেয়ে ! মনে মনে তন্ময় ভাবতে লাগলো !
- কিছু মনে করবেন না তন্ময় বাবু আমি একটু হাঁসি খুসি থাকতে ভালো বাসী ! তাই সব সময় একটু মজা করি ! যাতে সবার মনেতে একটু আনন্দ থাকে ! আমি কি ভুল বলুন?? অনামিকা প্রশ্ন করলেন তন্ময় বাবুকে !!
- না না আমি কেন কিছু মনে করতে যাব ! আমি নিজে হাঁসিখুসি থাকতে ভালবাসি ! আর তা ছাড়া আপনার কথাটাও তো ঠিক ! ঝুম্পার পিছনে ষাঁড় আর ষাঁড় এর পিছনে তো আমি সেদিন ছিলাম ! মানে কথা হলো ষাঁড়এ ঝুম্পাকে তারা করেছে আর আমি ষাঁড় কে ! তাই নয় কি??
- যাক বাবা বাঁচালেন ! আপনি তাহলে গম্ভীর মানুষ নন ! বাঁচা গেল ! এবার বলুন আমি আপনার জন্য কি করতে পারি !
তখন বিনয় বাবু আর বাসন্তি দেবী মিলে অনামিকাকে সমস্ত বোঝালেন !
- ঠিক আছে আমি আগে ওর বাবা মায়ের সাথে কথা বলি তারপর না হয় আপনাকে জনাব !
ঠি আছে ! তাহলে আজ চলি বলে বিনয় বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন !

1 টি মন্তব্য: