সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০১১

নষ্ট রাত


ছয় ঘন্টা গাড়িতে  থাকার দরুন গাড়ির শব্দটি খুবই সাধারণ ঠেকছে অথচ এই শব্দকে সে একদিন মোটেও  সহ্য করতে পারত নাস্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে পাশের বাড়ির সবদার শেখের  মেয়ের বিয়ের কথাসেবার দুদুটো বাস এসে প্রায় সফেলার উঠোনে এসে থামলো,  শব্দে তো প্রায় জানটার যায় যায় অবস্থা
সফেলা সেদিন সবদার শেখকে প্রাণ  ভরে গালি দিয়েছিলগালিটাই যে তার একমাত্র সম্বল! সবদার সাহেবদের কাছে  যেমন সফেলারা অতি তুচ্ছ, সফেলার গালির কাছে তেমনি সারা দুনিয়া তুচ্ছ-  সফেলাকে যারা চেনে এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন দ্বিমত ঘটবে নাতাই তো সফেলা  সুযোগ পেলেই এই কৃতিত্বটা কাজে লাগাইবাসটি তেল পাম্পে এসে থামলোসফেলার  ডান পাশের লোকটি প্রসাব করার জন্য তড়িঘড়ি করে নেমে পড়লো, বাম দিকের  লোকটি নড়েচড়ে বসলোএদের দুজনার সহায়তাই আজ সফেলা অন্ধকারকে গ্রাস করে  চলেছে পিসাচদের ক্যাম্পেওরা ইচ্ছে মত তাকে ভোগ করবে, প্রয়োজনে থাকতেও  হতে পারে কয়েক রাত- বিনিময়ে টাকা; কিন্তু কত দেবে ওরা! দেহের ওপর অনেক  ধকল যাবে ভাবতেই মুখ শুখিয়ে যায় সফেলারসে ধকল না হয় সয়লাম কিন্তু কত  দেবে ওরা- মনে মনে ভাবে সফেলাতাকে যা দেয়া হবে তার দুই ভাগ আবার যাবে এই  দালালদের পকেটেপ্রতিটা কারবারে মধ্যস্তকারীরা সবথেকে বেশি সুফল ভোগ করে,  এই বেশ্যা বাজারেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নাদালালদের সহায়তা ছাড়া যে  সফেলার পক্ষে আর কোন পাটি ধরা সম্ভব নাবেশ্যা বাজারে তার দাম পড়ে গেছে  একটা সময় ছিল যখন আগে থেকেই দামাদামী করে পা বাড়ানো যেতকিন্তু এখন আর  আগের সেই রুপ-যৌবন নেইশরীরে রস না থাকলে মাছি বসবে কেন! তাই দামাদামী  করতে গেলে হটিয়ে দেয় সকলেদশ বছর পূর্বেকার কথা মনে পড়তেই সফেলার মুখে  কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে ওঠেএক সাহেব গোছের মানুষ! সফেলার বয়স তখন বিশরসে  ভরা যৌবন দেখে সাহেব তো একেবারে পাগলপ্রায়! সাহেব হলে কি হবে- লোকটি  পাজি-নচ্ছড়; বৌ-বাচ্ছা রেখে চলে আসে সফেলার কাছে, সফেলাও খাসামাল, চেয়ে  বসে পাঁচশ টাকালোকটি এক কথাতেই রাজিসফেলা টানা নিঃশ্বাস ছাড়ে নিজের  অজান্তেইএ সমাজটাই হচ্ছে নচ্ছরএ সমাজস্থ প্রতিটি লোক বেশ্যা অথচ ভারটা  বইতে হয় সফেলার মত গুটি কতক অসহায় নারীকেরাত হলেই কত লোক যে লাইন জমাই  তাদের দরজায় তা সফেলা বেশ ভালো করেই জানে; রাত হলে সমাজের কত  হর্তা-কর্তারাও লালা ফেলতে ফেলতে বেশ্যা বাড়ীর সন্ধান করেওরাই বড়  বেশ্যা অথচ সকাল হবার সাথে সাথে যেন এক একজন ধোয়া তুলসী পাতাগাড়ীর শব্দ  ভোঁতা হয়ে আসছে ক্রমশঃভিতরের বাতিগুলো এখন বন্ধসকলে বোধহয় ঘুমাচ্ছে  বামের সিটে বসে থাকা দালালটির হাত আর নড়ছে নারাস্তায় হালকা আলো-ছায়া  সফেলাকে ভেংচি কেটে দ্রুত সরে পড়ছেরাতের নিরব আত্মা তাকে শাসিয়ে যাচ্ছে  ঘন ঘনদিনের আলো সফেলার গায়ে কাঁটা তারের মতন বিঁধে; অপমানে, লজ্জায়  কুকড়ে যায় তার সর্বাংগ, অথচ রাতের পৃথিবীতে সে খুবই স্বাভাবিকদিনের  আলোই যারা ভালো মানুষের মুখোস পরে সভ্যতার নকশা তৈরি করে রাতে তাদের উলংগ  চেহারা দেখে সফেলার খুব করুনা হয়সফেলা তো এই সমাজের-ই একজন, সমাজের  প্রতিটা মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে সেও বেঁচে থাকতে চাইছে; মোদ্দা কথা টিকে  থাকাটাই এখানে সবকোন জগতটা তবে বেশী সত্যি- রাতের নাকি দিনের! যদি রাতের  হয় তবে সফেলাতো অন্যায় কিছু করছে নাবেঁচে থাকার জন্যই আর পাঁচটা  ব্যবসায়ের মতন দেহ ব্যবসা করে, দৈহিক তাড়না কিম্বা ভোগ বিলাসিতার জন্য  নই, স্রেফ বেঁচে থাকার জন্যই; এক্ষেত্রে দেহ তার ব্যবসায়ের মূলধন; কিন্তু  সমাজের সভ্য মানুষগুলো তো তার কাছে আসে দেহের গন্ধে, মাংসাশী প্রাণীর মতন  খাবলে-খুবলে খায়, সুখের নেশায় মাতাল হয়ে আঁচড় কেটে দেয় নারীর ভেতরে  বাহিরেবেশ্যা শব্দটা যদি এতটাই ঘৃণার হবে তবে আসল বেশ্যা তো ওরা যারা  ঘন্টায় ঘন্টায় মুখোশ পাল্টায়, রাজত্ব করে ভন্ড সভ্যতারসফেলা হয়ত জানে  না, সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রয়োজনে এই সভ্যতা প্রতিনিয়ত ভল  পাল্টায়, মানবতার ভান ধরে চুষে খায় একটি শ্রেণীকে; মানুষে মানুষে তৈরী  হয় বিভেদ, এই বিভেদ ধনী-গরীবদের মাঝে, সুবিধাপ্রাপ্ত-নিগৃহীতদের মাঝে, এবং  যারা বিশ্বায়ন থেকে সুফল লাভ করেছে ও প্রান্তসীমায় জীবন-যাপন করছে তাদের  মাঝেশ্রমবিভাজনের যুগে মানুষে মানুষে যে সাম্যতা ছিল, জ্ঞান চর্চা  বৃদ্ধির সাথে সাথে তার তারতম্য ধটেছে; জ্ঞান চর্চা হয়েছে একটি বিশেষ  শ্রেণীর মৌলিক অধিকার- শোষনের মস্ত হাতিয়ার! প্রাচীন সভ্যতা ছিল নারী  ক্রেন্দ্রিক যেখানে বেশ্যালয় ছিল না; নারীরা ছিল পুরুষের মতই সাংসারিক  জীবপরবর্তীতে ধর্মের অকৃত্রিম সহযোগিতায় পুরুষরা নারীকে করলো কোনঠাসা  আধুনিক সভ্যতা হয়ে উঠলো সর্বাংশে পুরুষদের সভ্যতা, ধর্মতন্ত্র হয়ে উঠলো  পুরুষতন্ত্রের আরেকটি নাম মাত্রপুরুষদের ভোগে ভিন্নতা আনার জন্য নারীকে  করা হল পণ্য; ভেতরে ভেতরে বেশ্যাবৃত্তিকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করলেও নিজের  ঘরের মেয়েরা যাতে এ ব্যবসায়ে যেতে আগ্রহ না দেখাতে পারে এ জন্য কৌশলে  বেশ্যাদেরকে সমাজের বাইরে রাখা হলবেশ্যাবৃত্তিকে কোন দেশেই স্বভাবিকভাবে  গ্রহণ করা হয়নি অথচ এদের দ্বারা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে চলেছে অনেক দেশ-  থাইল্যান্ড তার জলন্ত প্রমাণবেশ্যাবৃত্তি এখন আন্তর্জাতিক ব্যবসা  শিক্ষিত সমাজের অনেকেই আজকাল ভিন্ন ভিন্ন দেহের গন্ধ নিতে ভিন্ন ভিন্ন দেশে  ছুটি কাটাতে যায়বর্তমানে যুব সমাজকে রক্ষায় বেশ্যালয়ের গুরুত্বকে  স্বীকার করে নেয়া হয়েছেবলা হয়ে থাকে- ‘Brothel is the Safety-valve of  the Society’! তাই যদি হয় তবে সফেলাকে সমাজের বাইরে বাস করতে হবে কেন!  এতসব বোঝেনা সফেলাএত বোঝবার জ্ঞান তার নেইসমাজের শিক্ষিতরা তার কাছে  জ্ঞান দিতে যায় না, যায় তাদের পাশবিক চেতনাকে উগরে দিতেএদেরকে অজ্ঞ করে  না রাখলে যে বড় ক্ষতিটা তাদেরই হবেঅন্ধকারে থাকে বলেই সফেলা জানে মানুষ  কতটা হিংস্র হতে পারেগাড়ীটা মেইন রোডের এক কোনায় থামলো- দশ মিনিটের  বিরতিদুয়েকটি দোকান এখনো খোলাবাম পাশের লোকটি বিড়ি কিনতে নেমে যায়,  সফেলা বুকের কাপড়টা ঠিক করে আলোর দিকে মুখ বের করে দেয়, চোখ পড়ে ল্যাম্প  পোস্টের আলোয় চকচক করতে থাকা সিনেমার পোস্টারের দিকেঅর্ধ-উলঙ্গ  নায়িকাদের খুঁটিয়ে দেখে সফেলাসমাজের এই উঁচু শ্রেণীর বেশ্যাদের দেখে  হিংসে হয় তারসমাজে এদের বেশ কদর আছে, টাকাও পায় ঢের বেশীআচ্ছা এরা কি  সুখ পাই, নাকি আমার মত ব্যথায় কুঁকড়ে যায়- মনে মনে ভাবে সফেলাপ্রচন্ড  সুখে যখন কাস্টমারদের মরে যেতে ইচ্ছে করে তখন তীব্র বেদনায় সফেলা খুব  কষ্ট করে জানটাকে ধরে রাখেপচিশ বছরের বেশ্যা জীবনে মাসিকের সময় যে  শান্তিটুকু পেয়েছে সে, এছাড়া আর অবসর মেলেনি জীবনেপ্রথম যে বার মাসিক  হয়, কি গালিটাই না দিয়েছিল মাসিককেকি ভয়ানক রক্ত দলা বেঁধে শরীর থেকে  নেমে আসে, তলপেট ব্যথায় কুঁকড়ে যায়, নারী জীবনে এর থেকে অভিশপ্ত আর  কিইবা হতে পারে! তখন কি জানতো সফেলা এই বিভৎস ঘটনাটাই তার জীবনে সবথেকে  সাধনার হবে! রাত দুটাসফেলার মনে হচ্ছে গাড়িটা অন্ধকারকে আঁকড়ে তর তর  করে বয়ে চলেছে অজানা এক শঙকার দিকেবাড়ীতে তার আট ও দশ বছরের মেয়ে দুটো  একাছেলেটা ছ মাস ধরে জেলেছাড়াতে অনেক টাকা লাগবেপুলিশের মন ভরানোর  মত বয়স ও টাকা কোনটাই তার নেইছেলেটা গেছে, এখনও সময় আছে মেয়ে দুটোকে  রক্ষা করারসফেলা অনেক ভেবে-চিন্তে সীদ্ধান্ত নিয়েছে, আজকের রাতটিই হবে  তার বেশ্যা জীবনের শেষ রাত; ওরা যে টাকা দেবে তা নিয়েই মেয়ে দুটোকে সংগে  করে এ সমাজের কোন এক গর্তে আশ্রয় খুজে নেবেটাকার কথা মনে হতেই  হার্টবিটটা বেড়ে যায় সফেলারবুক থেকে দালালের হাতটি হটিয়ে নিজের হাতটি  শক্ত করে চেপে ধরে সেখানে যেন জানটা বেরিয়ে না যায়আচ্ছা কত দেবে  ওরা!নাকি খালি হাতেই ফিরতে হবে- এই সংশয়টি তার সকল সংশয়কে পিছনে ফেলে পথ  রুদ্ধ করে দাঁড়াইএকটা সময় ছিল যখন ওরা রূপের ঝলক দেখে দুহাত ভরে দিত  তাইতো বেশ্যা বাজারে সকলে হিংসে করতো সফেলাকেএমনকি সতী-স্বাধী নারীরাও  আড়ালে সফেলার মত হতে চাইতোআর আজ ঝুলন্ত শরীর দেখে সকলে চোখ ফিরিয়ে নেই  এ ব্যবসায়ে কচি দেহ বিকোয় বেশিতাইতো সুযোগ পেলেই প্রতারণা করে সবাই,  সফেলাকে সয়তে হয় নিরবে- এ প্রতারণার যে কোন বিচার নেই, আদালত নেই, আর  থাকলেই বা কি লাভ! এদের করুনাতেই যে সফেলারা বেঁচে থাকে! আর জীবন? টানা  নিংশ্বাস ছাড়ে সফেলাএ সমাজ যে জুজু পাসন্ডরূপী সৃষ্টিকর্তাকে খাড়া  করেছে তার হাতে যে পরকালেও মুক্তি মিলবে না! গাড়ী এসে থামলো গন্তব্যে  দালাল দুজনের পিছন পিছন সফেলাও নেমে পড়ল হিড় হিড় করেআচ্ছা কত দেবে  ওরা- ফিসফিসিয়ে বলল নিজেকেবেশ কয়েক কদম হাঁটার পর পৌছাল পিশাচদের  ক্যাম্পেকড়া নাড়তেই ভেতর থেকে একটা ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘কে?’  সফেলার বাম পাশের লোকটি একটু বিনয়ের সুরে বলল, ‘আমরা, মাল লইয়া আইছি  ভেতর থেকে আর কোন সাড়া শব্দ আসে নাসফেলা ধৈর্য্যের বাধ ভেংগে বলল, ‘কত  দেবে ওরা?’ ডান দিকের লোকটা খিঁচুনি দিয়ে বলল, ‘চুপ কর খানকি মাগি, উহ্ তর  সইছে না!ভেতর থেকে একটা তৃপ্ত কন্ঠস্বর ভেসে এল, ‘আজ আর দরকার নেই; আমরা  কম বয়সী এক মাগি পাইছিঅন্যদিন নিয়ে এসোদালাল দুজন পিছন দিকে পা  বাড়ায়; সফেলা মাথা ধরে বসে পড়ে আরো এটি নষ্ট রাত, আরো একটি স্বপ্নের  প্রতিক্ষায়;-কিন্তু কত দেবে ওরা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন